II দেবাশিস ভট্টাচার্য II
এক
সে এক অন্য পৃথিবী। বিষাক্ত বায়ু তাকে ঘিরে রেখেছে।গর্ভে তার একতাল লাভা যেন ফুঁসছে। শূন্য থেকে ছিটকে আসা উল্কাপিণ্ড আছড়ে পড়ছে অবিরাম। থেকে থেকে তার জঠর ফুঁড়ে লাভা ও গ্যাস তীব্রবেগে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। সূর্য, যে ওই পৃথিবীর মতই নবীন, তার খর-দীপ্তি দিয়ে ঝলসে দিচ্ছে ছোট গ্রহটিকে। উত্তাল সমুদ্র আর কেঁপে কেঁপে ওঠা মেদিনীর মধ্যে যেন অবিরাম যুদ্ধ চলছে, সেইসঙ্গে দিনরাত আকাশ চিরে করাল বজ্রপাত।বাতাসের তীব্র বিষাক্ত গ্যাস বৃষ্টির সাথে মিশে ঝরে পড়ছে। নিঃসংশয়ে বলা যায় জলে স্থলে কথাও কোন প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই।
উন্মত্ত সেই কুম্ভীপাকে আশ্চর্য ভাবে ধ্বংস হাতছানি দিল সৃষ্টিকে। বজ্রাঘাতে ভাঙতে জুড়তে থাকা অণু-পরমাণু থেকে সৃষ্টি হয়ে প্রাণের মৌল উপাদান, জৈব অণুগুলি রক্তবীজের মত ছড়িয়ে পড়ল জলে- স্থলে। কিন্তু পৃথিবীর বুকে সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশে তাদের বিকাশ ছিল অসম্ভব। তাই সমুদ্রের গভীরে এক কোণে কয়েকটি অণু পাশাপাশি জুড়ে সৃষ্টি করল প্রথম জীব অথবা জীবাণু। শুরু হল জীবনের জয়যাত্রা।
শুধুই অণুর শৃঙ্খল, জীবকোষ তখনও গড়ে ওঠে নি। তবু জীবনের আদি প্রবৃত্তি অমোঘ লক্ষণ হয়ে দেখা দিল- এরা নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করে ছড়িয়ে যেতে থাকলো। উল্কাপাতের মাত্রা কমে আসায় সমুদ্রপৃষ্ঠে জীবাণু ছড়িয়ে যেতে থাকলো। ততদিনে জীবকোষ পূর্ণতার দিকে এগিয়ে গেছে, পরিপার্শ্ব থেকে প্রাণরস শুষে নেওয়ার প্রক্রিয়া কোষে শুরু হয়েছে। সেই প্রক্রিয়াতে কিছু জীবাণু অক্সিজেন নিঃসরন করত যা মাটিতে মিশে থাকতো। একসময় সেই অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলে জমা হতে থাকে। পৃথিবীর বাতাস দ্রুত বদলাতে থাকে। প্রায় অদৃশ্য ওই জীবাণুরা এভাবে সূচনা করছিল এক নূতন পৃথিবীর।
সূর্যের আলোয় অক্সিজেন ভেঙ্গে তৈরি হয় ওজোন। বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে জমা হয়ে সেই ওজোন প্রতিহত করে সূর্যের মারাত্মক অবলোহিত রশ্মি, যা জীবকোষকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। নতুন বায়ুমণ্ডলের আচ্ছাদনে সমস্ত গ্রহ জুড়ে শুরু হল জীবনের প্রগতি। বহুকোষী প্রাণী সমস্ত দেহ পেতে নরম সূর্যালোক শুষে নিয়ে বেড়ে উঠতে লাগলো, সবুজে ছেয়ে গেল পৃথিবীর জলভাগ। জলে ভেসে বেড়ানো শ্যাওলা থেকে জঙ্গম প্রাণীর বিকাশ হল যারা জল কেটে দূর- দুরান্তে চলে যেতে পারে।
ততদিনে পৃথিবী অনেক ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। বারবার পৃথিবীতে নেমে আসছে তুষারযুগ।অতল বরফের নীচে যুগ যুগ ধরে সুপ্ত থেকে হিম যুগের শেষে প্রতিবারই অদম্য প্রাণ জেগে ওঠে, এক থেকে বহু হয়ে ছড়িয়ে যায়।এমনই এক হিম যুগের শেষে জীবনের ইতিহাসে ঘটে যায় এক বিপ্লব।
জীবনের ইতিবৃত্ত খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের একমাত্র সম্বল ফসিল। জীবের বিকাশ সম্পূর্ণ হওয়ার আগে তাদের শরীরের কঠিন অংশ ছিল খুবই সামান্য, তাই বিজ্ঞানীদের ভরসা করতে হয়েছে পরোক্ষ চিহ্নে- যেমন পাথরের গায়ে রেখে যাওয়া অস্পষ্ট রেখায়। জীবনের ঊষাকালের ইতিহাস তাই অনেকটাই অনুমাননির্ভর। প্রায় সাতান্ন থেকে পঞ্চান্ন কোটি বছর আগের ভূস্তরের মধ্যেপাওয়া যায় বহু ফসিল যা বৈচিত্রে তার পূর্বসূরিদের তুলনায় একেবারে অভিনব। অর্থাৎ কোন অজ্ঞাত কারণে জীবজগতে ওই সময়ে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন যাতে বহু নতুন নতুন জীবের উদ্ভব হয়। তারাই আজকের জীবজগতের বিভিন্ন শাখার পূর্বসূরি।কি করে জানা যায় সেই বংশলতিকা ?
জীবকোষ তার বিকাশের পথে রেখে গেছে এক মূল্যবান অভিজ্ঞান। কোষের কেন্দ্রে থাকে কিছু অণুর শৃঙ্খল, যাকে বলা যায় জীবনের পদাবলী। তাতে গাঁথা থাকে জীবটির পূর্ণাঙ্গ রূপের যাবতীয় তথ্য। প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে সেই তথ্য সঞ্চারিত হয়ে চলে। আদিতম প্রাণ - গাছপালা জীবজন্তু আমাদের সবার যে বীজপুরুষ, তার কোষের থেকে আমার কোষে অযুত নিযুত যুগের সিঁড়ি বেয়ে আসা পদাবলীটি আজ শত শত মহাকাব্যের থেকেও বিপুলাকার, কিন্তু খুঁজলে তাতেও পাওয়া যায় আদি কবিতার শব্দ, পদ। সেই চিহ্ন ধরে জীবের বিবর্তনের একটি রূপরেখা তৈরি করে নেওয়া যায়।
পঞ্চান্ন-সাতান্ন কোটি বছর আগের সেই যুগেই জল থেকে স্থলে জীবের সঞ্চার হয়। প্রথমে উদ্ভিদ, পরে প্রাণী। যে পরাগ কোষ জলে ভেসে গিয়ে পরাগ মিলন ঘটাত তাই রেণুর আকারে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। পৃথিবীর মাটির রুক্ষ ধুসরতা ঢেকে গেল শ্যামলিমায়। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমান আরও বাড়ল। বায়ুমণ্ডলে জমা হতে লাগলো জলবাহী মেঘ, বৃষ্টি হযে যা নেমে আসতে লাগলো পৃথিবীর বুকে।
দুই
অনেক ধ্বংস, বিপর্যয়ের পথ পেরিয়ে কোন একটি সকালে এমন একটি দৃশ্য রচনা হোল-নীল আকাশের নীচে সমুদ্র, তটে আছড়ে পড়া ঢেউ, হাওয়ায় আন্দোলিত গাছপালা- এই গ্রহের প্রকৃতি সেজে উঠে যেন কার আগমনের প্রতীক্ষায় বসে। এই গ্রহের বুকে চলমান জীব তখন কিছু ক্রিমি ও কীট। নিতান্তই জৈবিক তাদের চেতনা- ক্ষুধা, আত্মরক্ষা ও বংশবিস্তার। খুবই সীমিত তাদের দৃষ্টি ও অনুভূতি; ক্ষুদ্রকায় তাদের মস্তিষ্ক। যেন প্রকৃতির রূপ বর্ণ গন্ধ শব্দ ধরা দেবে বলে দৈহিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্তরে একটু একটু করে বিকাশ হতে লাগলো তাদের মস্তিষ্কের।
এই বিকাশ নিরবচ্ছিন্ন হয় নি। মাঝে মাঝেই পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে ভয়ঙ্কর কোন না কোন দুর্যোগ, যাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অধিকাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ। তবু প্রাণের বীজ আবার, বারবার অঙ্কুরিত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। প্রাণের উত্তরাধিকার নিয়ে প্রতিবারই আশ্চর্য ভাবে রক্ষা পেয়ে গেছে কিছু প্রজাতি- যারা জীবনের ইতিহাসের নতুন অধ্যায় শুরু করেছে এই গ্রহে।
এভাবেই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে কীটপতঙ্গের পালা শেষ হয়ে শুরু হয় সরীসৃপযুগ। জীবনধারণের সংগ্রামে টিকে থাকতে গিয়ে তাদের মস্তিষ্ক দ্রুত বিকশিত হয়ে ওঠে। আকৃতিতে বিশাল এই জীবদের মধ্যে তৃণভোজী ও মাংসাশী দুই প্রজাতিই আলাদা ভাবে বিকশিত হয়। মাংসাশী প্রাণীদের জটিল মস্তিষ্কের অন্যতম কাজ ছিল হিংস্রতাকে আরও শানিয়ে জলে স্থলে তাদের আধিপত্য কায়েম করা।পৃথিবীতে রক্তপাতের ইতিহাসের সেই শুরু।
গ্রহময় কোন ভয়ংকর বিপর্যয়ে সরীসৃপ যুগের ওপর যবনিকা নেমে আসে। তাদেরই একটি শাখা ডানায় ভর করে আকাশে পাড়ি জমিয়েছিল কোন এক প্রজন্মে।তারা বেঁচে যায়। পাখীর পূর্বপুরুষ এরা। আর বেঁচে যায় সরীসৃপদের আহার্য ক্ষুদ্রকায় কিছু স্তন্যপায়ী জীব।
ধ্বংসের বিভীষিকা পিছনে ফেলে পৃথিবীর বুকে জীবনের যাত্রা সাময়িক ব্যহত হলেও থেমে যায় না। ক্ষুদ্রকায় স্তন্যপায়ীদের শাখাপ্রশাখা ক্রমে অধিকার করে নেয় পৃথিবীর স্থলভাগ। মস্তিষ্কের বিকাশের ফলেএদের মধ্যে ক্ষুধা, হিংসা, ভয় এসবের বাইরে জন্ম নেয় আবেগ, উদ্বেগ, সন্তানস্নেহ। জৈবিক আকুতি আত্মরক্ষার সীমা অতিক্রম করে। স্বার্থের পরিসরকে বিস্তৃত করার এই ধারা সময়ের সাথে, প্রজাতির বিবর্তনের সাথে আরও প্রসারিত হতে থাকে। প্রবৃত্তির এমন উত্তরণ টিকে থাকার লড়াইতে স্তন্যপায়ী জীবদের সাহায্য করেছিল বলেই বিবর্তন একে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়।
পৃথিবীর বুকে জীবের বিকাশের সম্পূর্ণ কাহিনীটি আমরা এখনও জানতে পারিনি। ফসিল ঘেঁটে জীবের শারীরিক বিকাশ নিয়ে হয়তো অনেক তথ্যই জানা যায়, কিন্তু মানসিক বা বৌদ্ধিক বিকাশের সুস্পষ্ট ছবি এখনও আমাদের অনায়ত্ত। মূলতঃ মাথার খুলির আয়তন থেকে ধারণা করা হয় কোন জীব কতটা বুদ্ধিমান ছিল। কিন্তু সেই বুদ্ধি কতটা বিকশিত ছিল অর্থাৎ ক্ষুন্নিবৃত্তি, আত্মরক্ষা, বংশবিস্তার - এসব আদিম চাহিদা মিটিয়ে আরও উন্নত স্তরের চিন্তাধারায় তারা সক্ষম ছিল কি না, তার কোন স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার উপায় এই মুহূর্তে আমাদের জানা নেই। ভিন্ন ভিন্ন মনোবিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন তত্বের অবতারণা করেছেন, কিন্তু কোনটাই অসংবাদিত নয়। তাই হয়তো আমরা কখনই সঠিক জানতে পারব না, কোন জীবটির চেতনায় প্রথম এই উদার আকাশ আর শ্যামল ধরা, এই রূপ বদলাতে থাকা প্রকৃতি ছায়া ফেলেছিল; রাতের আকাশের তারা বয়ে এনেছিল রহস্যময় কোন অস্তিত্বের ইঙ্গিত।
তিন
স্তন্যপায়ীদের বিচরণ ছিল বৃক্ষের শাখায় শাখায়। একসময় এরা নেমে এল মাটিতে। হাতের ব্যবহার শুধু চলনে সীমিত না থাকায় তাদের জীবনধারণে বড় পরিবর্তন আসতে থাকে। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে সম্পর্ক পরিবারের বাইরেও বিস্তৃতি পায়, এই পরিস্থিতির সাথে তাল মেলাতে মস্তিস্ককে আরও বিকশিত হয়ে উঠতে হয়। জান্তব প্রবৃত্তির স্বার্থপরতা বা সন্তান স্নেহের আবেগকে অতিক্রম করে তার চিন্তার জগত বিস্তৃত হল সামাজিক পরিসরে – সে গোষ্ঠীর ভালোমন্দ নিয়ে ভাবতে শুরু করল। এই পর্যায়ে তার মস্তিষ্কের দ্রুত বিকাশ ঘটে। উন্মেষ হয় কল্পনাশক্তির; মন কাল্পনিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আয়ত্ত করে।
জীবের আকারের সাথে সাথে মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি পাবে- এতে অভিনব কিছু নেই। কিন্তু এই কপিকুলের মস্তিষ্কে ‘ইন্সুলার কর্টেক্স’ নামের একটি অঞ্চল দ্রুত বিকশিত হয়ে উঠে তাদের আচার আচরণে আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। আকারে সর্ববৃহৎ না হলেও এদের মস্তিষ্ক অপেক্ষাকৃত জটিল চিন্তাভাবনার উৎস হয়ে ওঠে। বানর থেকে মানুষের বিবর্তনের পথে এই ইন্সুলার কর্টেক্সে নতুন নতুন অঞ্চলের উদ্ভব হয়েছে। সেই সঙ্গে জন্ম নিয়েছে সহানুভূতি, গোষ্ঠীচেতনা, আবেগ, হতাশা, বিশ্বাস, সন্দেহ, ভালোবাসা।
এম আর আই এর মত ইমেজিং এর নতুন সব পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে গভীর অনুসন্ধান সম্ভব হয়েছে। মানুষের মনের কোন আবেগের সাথে তার মস্তিষ্কের কোন অংশ যুক্ত এসব তথ্য আজ অনেকটাই জানা গেছে। দেখা গেছে ইন্সুলার কর্টেক্স খুবই অদ্ভুত একটি অঙ্গ। সঙ্গীত, ভাস্কর্য- এসব নান্দনিক বোধের উৎস এই অঙ্গে, যা মানুষের চিন্তাকে পৌঁছে দেয় ঈশ্বরের দরজায়। আবার ঘৃণা, হতাশা, মাদকাসক্তিও জন্ম নেয় একই অঞ্চলে। এর ফলে তার সামনে যুগপৎ স্বর্গ ও নরক, দুয়ের দরজাই খুলে যায়।
হয়তো এই প্রথম, সৃষ্টির কোন জীবের মনে সৃষ্টিকে নিয়ে বিস্ময়বোধ ও মুগ্ধতার জন্ম নেয়। তার সূত্র ধরে আসে চারপাশের জগতকে নিয়ে প্রশ্ন আর তার উত্তরের সন্ধান।অনন্ত মহাকাশ তাকে ঘিরে রেখেছে মায়াজালের মত, তারার আলো সুদুরের সঙ্কেত নিয়ে তার কাছে পৌঁছয়। তার বিস্ময়ের দৃষ্টি প্রসারিত হয় মহাশূন্যের গভীরে। বিন্দুবৎ কিছু কণা যেন অপরিমেয়, অসীম জগতে তার স্থান খোঁজে। সেই সন্ধান আজও অব্যহত।
লক্ষাধিক বছরের তার ইতিহাসের অধিকাংশ অতিবাহিত হয় অনিশ্চিত প্রকৃতিকে বুঝতে আর তাকে জীবনসংগ্রামে সহায় করতে। কিন্তু তারপরের সংগ্রাম চলে তার নিজের মস্তিষ্কের মধ্যে- এক অংশের সাথে অন্য অংশের।
যেসব অনুন্নত জীব প্রবৃত্তির বশ তারা স্বার্থত্যাগ করতে পারে না, কিন্তু ক্ষুৎপিপাসা, কামের নিবৃত্তি হয়ে গেলে তারাও শান্ত হয়। প্রবৃত্তিকে দমন করা যার আয়ত্বে সে যেমন ক্ষুৎপিপাসা ভুলে থাকতে পারে তেমনি আবার পিপাসা মেটার পরেও আকণ্ঠ পান করে যেতে পারে। তাই তার লোভের কোন গণ্ডী থাকে না। ইন্সুলার কর্টেক্সে নিহিত আসক্তি শুধু নেশার দ্রব্য নয়, ঘৃণা ও বিদ্বেষকেও অবলম্বন করতে পারে। মানুষের ইতিহাসে তাই দুই বিপরীত মেরুর কাহিনী পুনরাবৃত হতে থাকে। আত্মজ, আত্মজন- এমনকি মানবজাতির জন্য সুখ- স্বার্থ ত্যাগ করে দুঃখকে বরণ করার ইতিবৃত্তের পাশাপাশি অর্থহীন ক্রুর হিংসায় নিজেরই প্রজাতিকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করার কাহিনী।
প্রাণের বিকাশের পর থেকে পৃথিবীর বুকে বার বার নেমে এসেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়- প্রকৃতিদেবী যেন পরম মমতায় ছবি এঁকে হঠাৎ নিষ্ঠুর ভাবে সে ছবি মুছে দিয়েছেন বার বার।তবু প্রাণ ধ্বংস হয়ে যেতে যেতেও প্রবল জীবনতৃষ্ণা নিয়ে টিকে থেকেছে পৃথিবীর কোন এক কোণে- ভাবীকালে মাথা তুলে দাঁড়াবে বলে। আবার বিবর্তন, আবার বিকাশ এবং আবার নিয়তির মত সেই বিনাশ। বিকাশ আর ধ্বংসের চক্রাকার আবর্তনের পথে বিবর্তন এগিয়ে নিয়ে এসেছে জীবনকে কোটি কোটি বছরের পথ ধরে। মানুষের চেতনায় ধরা দিয়েছে তার চারপাশের অদ্ভুত সুন্দর রহস্যঘেরা তার বাসভূমি এই পৃথিবী।দেশ ও কালের সুদুরে তার দৃষ্টি সন্ধান দিয়েছে প্রকৃতির এক অচিন্তনীয় রূপের। এখনও কত বিচিত্র রহস্য তার চেতনায়, তার বোধিতে ধরা দেবে বলে অপেক্ষা করে আছে। প্রকৃতিদেবী কি মানুষকে সে সময়টুকু দেবেন?
এর থেকেও বড় প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ কি মানুষকে, সেই সময়টুকু দেবে? পাশাপাশি দরজা দুটির মধ্যে স্বর্গের দরজাটি কোন প্রাচীন কালেই বন্ধ হয়ে গেছে, সর্বাঙ্গে তার মরচে। নরকের দরজাটি যখন তখন খুলে যাচ্ছে। তার ওপারে মানুষের সীমাহীন লোভের গহীন অন্ধকার ।
বন্ধ দরজা অলৌকিক ভাবে খুলে যাওয়ার মত যদি মানুষের সুবুদ্ধি তাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচায়, তবে তার সাথে বেঁচে যাবে এই পৃথিবী, তার বায়ুমণ্ডল, তার চরাচরে ছড়িয়ে থাকা প্রাণ। সূর্য যতদিন আলো দিয়ে যাবে ততদিন।
অন্যথায় তার পরিবেশের সাথে মানুষও জীবাশ্ম হয়ে কালের গহ্বরে চলে যাবে। কিন্তু প্রাণ হয়তো এতো সহজে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে না। সে কোন সুদুর অতীতে সুপারনোভার গর্ভে জন্ম নেওয়া অণু একত্র হয়ে তৈরি করেছে এই গ্রহ, রচনা করেছে এক থেকে বহু হওয়ার মন্ত্র। অর্বুদ-কোটি বছরের তার নিয়তি এক লহমায়মুছে যাওয়ার নয়। হয়তো গহন সমুদ্রের কোন কন্দরে লুকিয়ে থাকবে কিছু অণুর শৃঙ্খল- কোনো নতুন প্রভাতে প্রাণের পদাবলী নতুন করে রচনা করবে বলে।
(শেষ)
এক
সে এক অন্য পৃথিবী। বিষাক্ত বায়ু তাকে ঘিরে রেখেছে।গর্ভে তার একতাল লাভা যেন ফুঁসছে। শূন্য থেকে ছিটকে আসা উল্কাপিণ্ড আছড়ে পড়ছে অবিরাম। থেকে থেকে তার জঠর ফুঁড়ে লাভা ও গ্যাস তীব্রবেগে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। সূর্য, যে ওই পৃথিবীর মতই নবীন, তার খর-দীপ্তি দিয়ে ঝলসে দিচ্ছে ছোট গ্রহটিকে। উত্তাল সমুদ্র আর কেঁপে কেঁপে ওঠা মেদিনীর মধ্যে যেন অবিরাম যুদ্ধ চলছে, সেইসঙ্গে দিনরাত আকাশ চিরে করাল বজ্রপাত।বাতাসের তীব্র বিষাক্ত গ্যাস বৃষ্টির সাথে মিশে ঝরে পড়ছে। নিঃসংশয়ে বলা যায় জলে স্থলে কথাও কোন প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই।
উন্মত্ত সেই কুম্ভীপাকে আশ্চর্য ভাবে ধ্বংস হাতছানি দিল সৃষ্টিকে। বজ্রাঘাতে ভাঙতে জুড়তে থাকা অণু-পরমাণু থেকে সৃষ্টি হয়ে প্রাণের মৌল উপাদান, জৈব অণুগুলি রক্তবীজের মত ছড়িয়ে পড়ল জলে- স্থলে। কিন্তু পৃথিবীর বুকে সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশে তাদের বিকাশ ছিল অসম্ভব। তাই সমুদ্রের গভীরে এক কোণে কয়েকটি অণু পাশাপাশি জুড়ে সৃষ্টি করল প্রথম জীব অথবা জীবাণু। শুরু হল জীবনের জয়যাত্রা।
শুধুই অণুর শৃঙ্খল, জীবকোষ তখনও গড়ে ওঠে নি। তবু জীবনের আদি প্রবৃত্তি অমোঘ লক্ষণ হয়ে দেখা দিল- এরা নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করে ছড়িয়ে যেতে থাকলো। উল্কাপাতের মাত্রা কমে আসায় সমুদ্রপৃষ্ঠে জীবাণু ছড়িয়ে যেতে থাকলো। ততদিনে জীবকোষ পূর্ণতার দিকে এগিয়ে গেছে, পরিপার্শ্ব থেকে প্রাণরস শুষে নেওয়ার প্রক্রিয়া কোষে শুরু হয়েছে। সেই প্রক্রিয়াতে কিছু জীবাণু অক্সিজেন নিঃসরন করত যা মাটিতে মিশে থাকতো। একসময় সেই অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলে জমা হতে থাকে। পৃথিবীর বাতাস দ্রুত বদলাতে থাকে। প্রায় অদৃশ্য ওই জীবাণুরা এভাবে সূচনা করছিল এক নূতন পৃথিবীর।
সূর্যের আলোয় অক্সিজেন ভেঙ্গে তৈরি হয় ওজোন। বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে জমা হয়ে সেই ওজোন প্রতিহত করে সূর্যের মারাত্মক অবলোহিত রশ্মি, যা জীবকোষকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। নতুন বায়ুমণ্ডলের আচ্ছাদনে সমস্ত গ্রহ জুড়ে শুরু হল জীবনের প্রগতি। বহুকোষী প্রাণী সমস্ত দেহ পেতে নরম সূর্যালোক শুষে নিয়ে বেড়ে উঠতে লাগলো, সবুজে ছেয়ে গেল পৃথিবীর জলভাগ। জলে ভেসে বেড়ানো শ্যাওলা থেকে জঙ্গম প্রাণীর বিকাশ হল যারা জল কেটে দূর- দুরান্তে চলে যেতে পারে।
ততদিনে পৃথিবী অনেক ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। বারবার পৃথিবীতে নেমে আসছে তুষারযুগ।অতল বরফের নীচে যুগ যুগ ধরে সুপ্ত থেকে হিম যুগের শেষে প্রতিবারই অদম্য প্রাণ জেগে ওঠে, এক থেকে বহু হয়ে ছড়িয়ে যায়।এমনই এক হিম যুগের শেষে জীবনের ইতিহাসে ঘটে যায় এক বিপ্লব।
জীবনের ইতিবৃত্ত খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের একমাত্র সম্বল ফসিল। জীবের বিকাশ সম্পূর্ণ হওয়ার আগে তাদের শরীরের কঠিন অংশ ছিল খুবই সামান্য, তাই বিজ্ঞানীদের ভরসা করতে হয়েছে পরোক্ষ চিহ্নে- যেমন পাথরের গায়ে রেখে যাওয়া অস্পষ্ট রেখায়। জীবনের ঊষাকালের ইতিহাস তাই অনেকটাই অনুমাননির্ভর। প্রায় সাতান্ন থেকে পঞ্চান্ন কোটি বছর আগের ভূস্তরের মধ্যেপাওয়া যায় বহু ফসিল যা বৈচিত্রে তার পূর্বসূরিদের তুলনায় একেবারে অভিনব। অর্থাৎ কোন অজ্ঞাত কারণে জীবজগতে ওই সময়ে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন যাতে বহু নতুন নতুন জীবের উদ্ভব হয়। তারাই আজকের জীবজগতের বিভিন্ন শাখার পূর্বসূরি।কি করে জানা যায় সেই বংশলতিকা ?
জীবকোষ তার বিকাশের পথে রেখে গেছে এক মূল্যবান অভিজ্ঞান। কোষের কেন্দ্রে থাকে কিছু অণুর শৃঙ্খল, যাকে বলা যায় জীবনের পদাবলী। তাতে গাঁথা থাকে জীবটির পূর্ণাঙ্গ রূপের যাবতীয় তথ্য। প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে সেই তথ্য সঞ্চারিত হয়ে চলে। আদিতম প্রাণ - গাছপালা জীবজন্তু আমাদের সবার যে বীজপুরুষ, তার কোষের থেকে আমার কোষে অযুত নিযুত যুগের সিঁড়ি বেয়ে আসা পদাবলীটি আজ শত শত মহাকাব্যের থেকেও বিপুলাকার, কিন্তু খুঁজলে তাতেও পাওয়া যায় আদি কবিতার শব্দ, পদ। সেই চিহ্ন ধরে জীবের বিবর্তনের একটি রূপরেখা তৈরি করে নেওয়া যায়।
পঞ্চান্ন-সাতান্ন কোটি বছর আগের সেই যুগেই জল থেকে স্থলে জীবের সঞ্চার হয়। প্রথমে উদ্ভিদ, পরে প্রাণী। যে পরাগ কোষ জলে ভেসে গিয়ে পরাগ মিলন ঘটাত তাই রেণুর আকারে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। পৃথিবীর মাটির রুক্ষ ধুসরতা ঢেকে গেল শ্যামলিমায়। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমান আরও বাড়ল। বায়ুমণ্ডলে জমা হতে লাগলো জলবাহী মেঘ, বৃষ্টি হযে যা নেমে আসতে লাগলো পৃথিবীর বুকে।
দুই
অনেক ধ্বংস, বিপর্যয়ের পথ পেরিয়ে কোন একটি সকালে এমন একটি দৃশ্য রচনা হোল-নীল আকাশের নীচে সমুদ্র, তটে আছড়ে পড়া ঢেউ, হাওয়ায় আন্দোলিত গাছপালা- এই গ্রহের প্রকৃতি সেজে উঠে যেন কার আগমনের প্রতীক্ষায় বসে। এই গ্রহের বুকে চলমান জীব তখন কিছু ক্রিমি ও কীট। নিতান্তই জৈবিক তাদের চেতনা- ক্ষুধা, আত্মরক্ষা ও বংশবিস্তার। খুবই সীমিত তাদের দৃষ্টি ও অনুভূতি; ক্ষুদ্রকায় তাদের মস্তিষ্ক। যেন প্রকৃতির রূপ বর্ণ গন্ধ শব্দ ধরা দেবে বলে দৈহিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্তরে একটু একটু করে বিকাশ হতে লাগলো তাদের মস্তিষ্কের।
এই বিকাশ নিরবচ্ছিন্ন হয় নি। মাঝে মাঝেই পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে ভয়ঙ্কর কোন না কোন দুর্যোগ, যাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অধিকাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ। তবু প্রাণের বীজ আবার, বারবার অঙ্কুরিত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। প্রাণের উত্তরাধিকার নিয়ে প্রতিবারই আশ্চর্য ভাবে রক্ষা পেয়ে গেছে কিছু প্রজাতি- যারা জীবনের ইতিহাসের নতুন অধ্যায় শুরু করেছে এই গ্রহে।
এভাবেই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে কীটপতঙ্গের পালা শেষ হয়ে শুরু হয় সরীসৃপযুগ। জীবনধারণের সংগ্রামে টিকে থাকতে গিয়ে তাদের মস্তিষ্ক দ্রুত বিকশিত হয়ে ওঠে। আকৃতিতে বিশাল এই জীবদের মধ্যে তৃণভোজী ও মাংসাশী দুই প্রজাতিই আলাদা ভাবে বিকশিত হয়। মাংসাশী প্রাণীদের জটিল মস্তিষ্কের অন্যতম কাজ ছিল হিংস্রতাকে আরও শানিয়ে জলে স্থলে তাদের আধিপত্য কায়েম করা।পৃথিবীতে রক্তপাতের ইতিহাসের সেই শুরু।
গ্রহময় কোন ভয়ংকর বিপর্যয়ে সরীসৃপ যুগের ওপর যবনিকা নেমে আসে। তাদেরই একটি শাখা ডানায় ভর করে আকাশে পাড়ি জমিয়েছিল কোন এক প্রজন্মে।তারা বেঁচে যায়। পাখীর পূর্বপুরুষ এরা। আর বেঁচে যায় সরীসৃপদের আহার্য ক্ষুদ্রকায় কিছু স্তন্যপায়ী জীব।
ধ্বংসের বিভীষিকা পিছনে ফেলে পৃথিবীর বুকে জীবনের যাত্রা সাময়িক ব্যহত হলেও থেমে যায় না। ক্ষুদ্রকায় স্তন্যপায়ীদের শাখাপ্রশাখা ক্রমে অধিকার করে নেয় পৃথিবীর স্থলভাগ। মস্তিষ্কের বিকাশের ফলেএদের মধ্যে ক্ষুধা, হিংসা, ভয় এসবের বাইরে জন্ম নেয় আবেগ, উদ্বেগ, সন্তানস্নেহ। জৈবিক আকুতি আত্মরক্ষার সীমা অতিক্রম করে। স্বার্থের পরিসরকে বিস্তৃত করার এই ধারা সময়ের সাথে, প্রজাতির বিবর্তনের সাথে আরও প্রসারিত হতে থাকে। প্রবৃত্তির এমন উত্তরণ টিকে থাকার লড়াইতে স্তন্যপায়ী জীবদের সাহায্য করেছিল বলেই বিবর্তন একে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়।
পৃথিবীর বুকে জীবের বিকাশের সম্পূর্ণ কাহিনীটি আমরা এখনও জানতে পারিনি। ফসিল ঘেঁটে জীবের শারীরিক বিকাশ নিয়ে হয়তো অনেক তথ্যই জানা যায়, কিন্তু মানসিক বা বৌদ্ধিক বিকাশের সুস্পষ্ট ছবি এখনও আমাদের অনায়ত্ত। মূলতঃ মাথার খুলির আয়তন থেকে ধারণা করা হয় কোন জীব কতটা বুদ্ধিমান ছিল। কিন্তু সেই বুদ্ধি কতটা বিকশিত ছিল অর্থাৎ ক্ষুন্নিবৃত্তি, আত্মরক্ষা, বংশবিস্তার - এসব আদিম চাহিদা মিটিয়ে আরও উন্নত স্তরের চিন্তাধারায় তারা সক্ষম ছিল কি না, তার কোন স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার উপায় এই মুহূর্তে আমাদের জানা নেই। ভিন্ন ভিন্ন মনোবিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন তত্বের অবতারণা করেছেন, কিন্তু কোনটাই অসংবাদিত নয়। তাই হয়তো আমরা কখনই সঠিক জানতে পারব না, কোন জীবটির চেতনায় প্রথম এই উদার আকাশ আর শ্যামল ধরা, এই রূপ বদলাতে থাকা প্রকৃতি ছায়া ফেলেছিল; রাতের আকাশের তারা বয়ে এনেছিল রহস্যময় কোন অস্তিত্বের ইঙ্গিত।
তিন
স্তন্যপায়ীদের বিচরণ ছিল বৃক্ষের শাখায় শাখায়। একসময় এরা নেমে এল মাটিতে। হাতের ব্যবহার শুধু চলনে সীমিত না থাকায় তাদের জীবনধারণে বড় পরিবর্তন আসতে থাকে। গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে সম্পর্ক পরিবারের বাইরেও বিস্তৃতি পায়, এই পরিস্থিতির সাথে তাল মেলাতে মস্তিস্ককে আরও বিকশিত হয়ে উঠতে হয়। জান্তব প্রবৃত্তির স্বার্থপরতা বা সন্তান স্নেহের আবেগকে অতিক্রম করে তার চিন্তার জগত বিস্তৃত হল সামাজিক পরিসরে – সে গোষ্ঠীর ভালোমন্দ নিয়ে ভাবতে শুরু করল। এই পর্যায়ে তার মস্তিষ্কের দ্রুত বিকাশ ঘটে। উন্মেষ হয় কল্পনাশক্তির; মন কাল্পনিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আয়ত্ত করে।
জীবের আকারের সাথে সাথে মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি পাবে- এতে অভিনব কিছু নেই। কিন্তু এই কপিকুলের মস্তিষ্কে ‘ইন্সুলার কর্টেক্স’ নামের একটি অঞ্চল দ্রুত বিকশিত হয়ে উঠে তাদের আচার আচরণে আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। আকারে সর্ববৃহৎ না হলেও এদের মস্তিষ্ক অপেক্ষাকৃত জটিল চিন্তাভাবনার উৎস হয়ে ওঠে। বানর থেকে মানুষের বিবর্তনের পথে এই ইন্সুলার কর্টেক্সে নতুন নতুন অঞ্চলের উদ্ভব হয়েছে। সেই সঙ্গে জন্ম নিয়েছে সহানুভূতি, গোষ্ঠীচেতনা, আবেগ, হতাশা, বিশ্বাস, সন্দেহ, ভালোবাসা।
এম আর আই এর মত ইমেজিং এর নতুন সব পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে গভীর অনুসন্ধান সম্ভব হয়েছে। মানুষের মনের কোন আবেগের সাথে তার মস্তিষ্কের কোন অংশ যুক্ত এসব তথ্য আজ অনেকটাই জানা গেছে। দেখা গেছে ইন্সুলার কর্টেক্স খুবই অদ্ভুত একটি অঙ্গ। সঙ্গীত, ভাস্কর্য- এসব নান্দনিক বোধের উৎস এই অঙ্গে, যা মানুষের চিন্তাকে পৌঁছে দেয় ঈশ্বরের দরজায়। আবার ঘৃণা, হতাশা, মাদকাসক্তিও জন্ম নেয় একই অঞ্চলে। এর ফলে তার সামনে যুগপৎ স্বর্গ ও নরক, দুয়ের দরজাই খুলে যায়।
হয়তো এই প্রথম, সৃষ্টির কোন জীবের মনে সৃষ্টিকে নিয়ে বিস্ময়বোধ ও মুগ্ধতার জন্ম নেয়। তার সূত্র ধরে আসে চারপাশের জগতকে নিয়ে প্রশ্ন আর তার উত্তরের সন্ধান।অনন্ত মহাকাশ তাকে ঘিরে রেখেছে মায়াজালের মত, তারার আলো সুদুরের সঙ্কেত নিয়ে তার কাছে পৌঁছয়। তার বিস্ময়ের দৃষ্টি প্রসারিত হয় মহাশূন্যের গভীরে। বিন্দুবৎ কিছু কণা যেন অপরিমেয়, অসীম জগতে তার স্থান খোঁজে। সেই সন্ধান আজও অব্যহত।
লক্ষাধিক বছরের তার ইতিহাসের অধিকাংশ অতিবাহিত হয় অনিশ্চিত প্রকৃতিকে বুঝতে আর তাকে জীবনসংগ্রামে সহায় করতে। কিন্তু তারপরের সংগ্রাম চলে তার নিজের মস্তিষ্কের মধ্যে- এক অংশের সাথে অন্য অংশের।
যেসব অনুন্নত জীব প্রবৃত্তির বশ তারা স্বার্থত্যাগ করতে পারে না, কিন্তু ক্ষুৎপিপাসা, কামের নিবৃত্তি হয়ে গেলে তারাও শান্ত হয়। প্রবৃত্তিকে দমন করা যার আয়ত্বে সে যেমন ক্ষুৎপিপাসা ভুলে থাকতে পারে তেমনি আবার পিপাসা মেটার পরেও আকণ্ঠ পান করে যেতে পারে। তাই তার লোভের কোন গণ্ডী থাকে না। ইন্সুলার কর্টেক্সে নিহিত আসক্তি শুধু নেশার দ্রব্য নয়, ঘৃণা ও বিদ্বেষকেও অবলম্বন করতে পারে। মানুষের ইতিহাসে তাই দুই বিপরীত মেরুর কাহিনী পুনরাবৃত হতে থাকে। আত্মজ, আত্মজন- এমনকি মানবজাতির জন্য সুখ- স্বার্থ ত্যাগ করে দুঃখকে বরণ করার ইতিবৃত্তের পাশাপাশি অর্থহীন ক্রুর হিংসায় নিজেরই প্রজাতিকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করার কাহিনী।
প্রাণের বিকাশের পর থেকে পৃথিবীর বুকে বার বার নেমে এসেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়- প্রকৃতিদেবী যেন পরম মমতায় ছবি এঁকে হঠাৎ নিষ্ঠুর ভাবে সে ছবি মুছে দিয়েছেন বার বার।তবু প্রাণ ধ্বংস হয়ে যেতে যেতেও প্রবল জীবনতৃষ্ণা নিয়ে টিকে থেকেছে পৃথিবীর কোন এক কোণে- ভাবীকালে মাথা তুলে দাঁড়াবে বলে। আবার বিবর্তন, আবার বিকাশ এবং আবার নিয়তির মত সেই বিনাশ। বিকাশ আর ধ্বংসের চক্রাকার আবর্তনের পথে বিবর্তন এগিয়ে নিয়ে এসেছে জীবনকে কোটি কোটি বছরের পথ ধরে। মানুষের চেতনায় ধরা দিয়েছে তার চারপাশের অদ্ভুত সুন্দর রহস্যঘেরা তার বাসভূমি এই পৃথিবী।দেশ ও কালের সুদুরে তার দৃষ্টি সন্ধান দিয়েছে প্রকৃতির এক অচিন্তনীয় রূপের। এখনও কত বিচিত্র রহস্য তার চেতনায়, তার বোধিতে ধরা দেবে বলে অপেক্ষা করে আছে। প্রকৃতিদেবী কি মানুষকে সে সময়টুকু দেবেন?
এর থেকেও বড় প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ কি মানুষকে, সেই সময়টুকু দেবে? পাশাপাশি দরজা দুটির মধ্যে স্বর্গের দরজাটি কোন প্রাচীন কালেই বন্ধ হয়ে গেছে, সর্বাঙ্গে তার মরচে। নরকের দরজাটি যখন তখন খুলে যাচ্ছে। তার ওপারে মানুষের সীমাহীন লোভের গহীন অন্ধকার ।
বন্ধ দরজা অলৌকিক ভাবে খুলে যাওয়ার মত যদি মানুষের সুবুদ্ধি তাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচায়, তবে তার সাথে বেঁচে যাবে এই পৃথিবী, তার বায়ুমণ্ডল, তার চরাচরে ছড়িয়ে থাকা প্রাণ। সূর্য যতদিন আলো দিয়ে যাবে ততদিন।
অন্যথায় তার পরিবেশের সাথে মানুষও জীবাশ্ম হয়ে কালের গহ্বরে চলে যাবে। কিন্তু প্রাণ হয়তো এতো সহজে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে না। সে কোন সুদুর অতীতে সুপারনোভার গর্ভে জন্ম নেওয়া অণু একত্র হয়ে তৈরি করেছে এই গ্রহ, রচনা করেছে এক থেকে বহু হওয়ার মন্ত্র। অর্বুদ-কোটি বছরের তার নিয়তি এক লহমায়মুছে যাওয়ার নয়। হয়তো গহন সমুদ্রের কোন কন্দরে লুকিয়ে থাকবে কিছু অণুর শৃঙ্খল- কোনো নতুন প্রভাতে প্রাণের পদাবলী নতুন করে রচনা করবে বলে।
(শেষ)
No comments:
Post a Comment