Translate

Friday, July 15, 2016

ফৈয়াজ খাঁ সাব কা মাজার



|| দেবাশিস ভট্টাচার্য ||

বঢ়োদরা অর্থাৎ বরোদা স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি গাড়ির অপেক্ষায়। ভোর পাঁচটা, তবু তখনও আলো ফোটেনি। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তার ওপারে নতুন পুরনো হোটেলের সারি। এর মধ্যে একটা হোটেল অনেকটা জায়গা জুড়ে, সর্বাঙ্গে তার প্রাচীনতার ছাপ। কাঠের রেলিং দেওয়া দোতলার বারান্দায় টিম টিম করে জ্বলছে হলুদ বাল্ব, সারি সারি রুম গুলোতে বোর্ডার আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। দরজাগুলো কোনো ঐতিহাসিক কালে নীল রঙের ছিল - তার কব্জাগুলোতে হয়তো মরচে ধরে গেছে। একসময়- যখন সয়াজি রাও গায়কোয়াড়ের বরোদার খ্যাতি সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে আর তাতে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসছেন দেশ বিদেশের জ্ঞানী গুণীরা- বহু ভাগ্যান্বেষী রাজানুগ্রহ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই শহরে এসে এমনই কোন হোটেলে ঠাঁই নিত। তখন দুরপাল্লার বাহন বলতে ছিল রেলগাড়ি, তাই হোটেলগুলো সাধারণতঃ হতো স্টেশনের কাছেই। হয়তো তরুণ আব্দুল করিম খাঁ তার ভাই আব্দুল হককে নিয়ে অথবা যুবক ফৈয়াজ খাঁও ওইরকমই কোনো এক রুমে এসে উঠেছিলেন। হয়তো তাদের কড়ি বরগা দেয়াল সাক্ষী হয়ে আছে উদীয়মান ওস্তাদদের উদয়াস্ত সাধনার। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

দীর্ঘদিন পর বরোদাতে আসা। তাই স্টাফ কলেজের, এখন যার নাম হয়েছে NAIR, হোস্টেলে যাওয়ার পথে স্মৃতির সাথে বর্তমানকে মিলিয়ে নিতে গিয়ে বারবার খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। তবু রাজপ্রাসাদের সামনের রাস্তাটা একই রকম আছে, মাঝে মাঝে দু একটা বহুতল, দোকান, রেস্তোরাঁ বাদে। সিংহদ্বারের উল্টোদিকে রাস্তার ওপারে কিছু পুরনো মহল ভগ্নদশায় এখনও দাঁড়িয়ে আছে, কবে রিয়েল এস্টেটের কারবারিদের কব্জায় যাবে সেই প্রতীক্ষায়। রাজদরবারে অথবা রাজকীয় প্রতিষ্ঠানে যাঁদের বিশেষ স্থান ছিল, তাঁরা ছিলেন এইসব মহলের বাসিন্দা। হয়তো এরই কোন একটাতে ছিলেন আমাদের আলীসাহেব, সৈয়দ মুজতবা আলী।

বরোদার সেই স্বর্ণযুগের যারা ছিলেন হোতা, তাদের চিহ্ন যা কিছু রয়েছে, সব ওই প্রাসাদ সংলগ্ন ম্যুজিয়ামে। শুধু একজনই আমৃত্যু বরোদার মায়া কাটাতে পারেন নি, মৃত্যুর পর দফন হয়েছেন তাঁর যৌবনের উপবন, বার্ধক্যের বারানসীতে। তিনি ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেব।

শহরের কোন অঞ্চলে তাঁর মাজার, সেটা আমার জানা ছিল না। খানিকটা অনুসন্ধানের ফলে জানতে পারলাম, সেটা খাসওয়াড়ি মহল্লাতে, আরাধনা সিনেমার কাছে। এক ছুটির দিনে আরাধনা সিনেমার কাছে অটো থেকে নেমে খাসওয়াড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে খাসওয়াড়ি পৌঁছে গেলাম, তবু মাজার দূরে থাক, কোন গোরস্থানই চোখে পড়লো না। উল্টোদিক ধরে আবার হাঁটতে হাঁটতে কিছুদুর আসার পর একটি মসজিদ চোখে পড়লো। গেট খোলা, নির্জন। ভেতরে ঢুকে 'জী কোই হ্যায়' হাঁক পাড়তে এক বৃদ্ধ উদয় হলেন, হাতে উর্দু কাগজ। 'য়ঁহা আসপাশ কহীঁ ফৈয়াজ খাঁ সাবকা মাজার হ্যায়?' বৃদ্ধের মাথা নাড়া আর চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারলাম কস্মিন কালেও তিনি ওই নাম শোনেন নি। চলে যাচ্ছি যখন, বললেন, 'আগে চৌড়ায়া পে এক কব্রীস্তান হ্যায়, ওঁহা পাতা কর লিজিয়ে।' চৌমাথায় এসে ভালো করে দেখেও কিছু হদিশ করতে পারলাম না, অধিকাংশই মোটর পার্টসের দোকান। শেষ চেষ্টা হিসেবে একটি গ্যারেজের সামনের দোকানে এক যুবক চা খাচ্ছিল, তাকে জিজ্ঞেস করলাম। 'ফৈয়াজ খাঁ? গায়ক?' আহা! এ কী শুনলাম! আমার মাথানাড়ার প্রাবল্যে খানিকটা বিস্মিত যুবকটি গ্যারেজের পেছনের একটি মাঠ দেখাল। বলল- ওই দিকে একটি গেট আছে, আবার খানিকটা ঘুরে রাস্তার দিকেও একটি গেট আছে। কোনটা খোলা আছে বলতে পারবে না। দিশারীটিকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে গ্যারেজের পেছনের মাঠে গিয়ে দেখলাম উঁচু প্রাচীর ঘেরা একটা কিছু রয়েছে, কিন্তু গেট বন্ধ। অগত্যা রাস্তার দিকের গেটের সন্ধানে গেলাম। ওপরের সাইন বোর্ড দেখে জানলাম, সেটি শিয়া কব্রীস্তান। সে গেটও বন্ধ, কখন খোলে কেউ বলতে পারলো না। তবে গেটটি তেমন উঁচু নয়, তাই ভেতরে দেখা যায়। মাজার বলতে, কম্পাউন্ডের বাঁদিকের দেয়াল সংলগ্ন আচ্ছাদনের নীচে একটি কবর আর দুপাশে জাফরি কাটা দেয়াল। সেটিতেই শায়িত কণ্ঠ সঙ্গীতের শেষ সম্রাট।

ইচ্ছে ছিল তাঁর কবরে ফুল দেব, সে ইচ্ছে পূরণ হল না। বাইরে থেকেই প্রণাম জানালাম। জানিনা আজ আর কেউ ওই গেট খুলে তাঁর মাজারে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয় কিনা, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। গুজরাতে দাঙ্গার সময় কিছু নরাধম নাকি তাঁর মাজারে জ্বলন্ত টায়ার নিক্ষেপ করেছিল, তারা আমারই ধর্মের, তাই সেই লজ্জা নিয়েই মাথা নত করে রই। তিনি সঙ্গীত দিয়ে ঈশ্বরের চরণ স্পর্শ করেছেন, যদি স্বর্গ বা বেহেস্ত বলে কিছু থাকে, তাতে শরণ পেয়েছেন। ওই কলুষ তাঁকে তাই স্পর্শ করে না। যা কিছু অগৌরব, হতাশা, ক্ষতি তা আমাদের, তা আমার।

No comments:

Post a Comment