|| দেবাশিস ভট্টাচার্য ||
এক বিজ্ঞানী ও তাঁর সহকারী। রাতের অন্ধকারে এসে দাঁড়ালেন উন্মুক্ত প্রান্তরে। দুজনেরই হাতে লন্ঠন, যেটার কাঁচের ওপরের ঢাকনা দ্রুত খোলা বা বন্ধ করা যায়।তাঁদের মধ্যে কথা হল যে, বিজ্ঞানী একমাইল দুরের টিলার ওপর দাঁড়িয়ে তাঁর লন্ঠনের ঢাকনা খুলবেন। সহকারী সেই আলো দেখতে পেলে তাঁর হাতের লন্ঠনের ঢাকনাটা খুলবেন।
আসলে বিজ্ঞানীটি মাপতে চলেছিলেন আলোর গতিবেগ।যেটা এতকাল অসীম বলেই ধরে এসেছে সবাই। কিন্তু তিনি যেহেতু গ্যালিলিও, প্রমাণ ছাড়া সেটা মেনে নেন কি করে?
কিন্তু সে যাত্রায় গ্যালিলিওকে নিরাশ হতে হল। আজ আমরা জানি, এক মাইল পথ আসা যাওয়া করতে আলো সময় নেয় সেকেন্ডের একলক্ষ ভাগের একভাগ প্রায়। ওই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মানুষের কর্ম নয়, তাই গ্যালিলিওর কাছে অসীম ধরা দিল না।তবে ওই অসীমের ব্যাপারটাতেও তিনি নিঃসন্দিহান হতে পারলেন না।
এর কয়েক দশক পরে ১৬৭৬ সালে ডেনমার্কের বিজ্ঞানী রোমার দূরবীনে বৃহস্পতির উপগ্রহ আইওর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বৃহস্পতির চারদিকে পাক খেতে খেতে আইও গ্রহের পিছনে ঢাকা পরে গেলে তার গ্রহণ হয়, রোমার দেখলেন গ্রহণ একই সময়ে হচ্ছে না। বৃহস্পতি যখন পৃথিবীর একেবারে কাছে, তখন গ্রহণের সময় এগিয়ে যাচ্ছে। রাতের আকাশে যখন বৃহস্পতি পৃথিবীর থেকে সবচাইতে দূরে, তখন গ্রহণের সময় প্রায় দশ মিনিট পিছিয়ে যাচ্ছে। এর একটাই ব্যাখা সম্ভব- যখন বৃহস্পতি ও আইও বেশী দূরে, আইও থেকে প্রতিফলিত আলো পৃথিবীতে আসতে বেশী সময় নিচ্ছে। আলোর গতি প্রচণ্ড বেশী হলেও যে তা সীমিত, তার প্রমাণ হাতেনাতে পাওয়া গেল।
কিন্তু সেই গতিবেগ কত? রোমারের সময় পৃথিবী থেকে সূর্যের দুরত্ব জানা ছিল না। তাই সেই গতির হিসেব করা গেল না। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রাডলি দেখলেন, রাতের আকাশে একটা বিশেষ সময়ে কোন একটি তারার অবস্থান একই থাকছে না। পৃথিবী তার কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে তার বেগ বাড়ে কমে - যখন সূর্যের কাছে, তখন তার বেগ বেশী, দূরে গেলে কম। পৃথিবীর বেগের সাথে সাথে তারাদের অবস্থানে সূক্ষ্ম পরিবর্তন হচ্ছে। একে বলে Stellar aberration । তিনি অঙ্ক কষে দেখলেন এই পরিবর্তনের মান পৃথিবীর গতি আর আলোর গতির আনুপাতিক হওয়া উচিত। পৃথিবীর গতি যেহেতু জানা ছিল, ব্রাডলি মানব ইতিহাসে প্রথম আলোর গতির পরিমাপ করতে পারলেন- তিন লক্ষ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড।
ব্রাডলির পর কেটে গেছে প্রায় তিনটি শতাব্দী। এখন আমরা একদিকে যেমন পেয়েছি লেজার রশ্মি তেমনি হাতে পেয়েছি নিমেষ- মুহূর্ত মাপার মত সূক্ষ ঘড়ি। এসব নিয়ে মাপজোখ করে আলোর গতির যে সর্বাধুনিক পরিমাপ পাওয়া গেছে, সেটা হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ২৯,৯৭,৯২, ৪৫৮ মিটার। অর্থাৎ ২.৯৯ লক্ষ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড। তিনশো বছর আগের ব্রাডলি সাহেবের পর্যবেক্ষণের তারিফ না করে উপায় নেই!
আলোর গতি আমাদের সবার কাছে C চিহ্নে পরিচিত। এই C এসেছে লাতিন Celeritas থেকে। যার অর্থ ক্ষিপ্রতা। আজ আমরা জানি, ক্ষিপ্রতার পরাকাষ্ঠা আলোর গতি। কোনো পদার্থ বা শক্তি এর থেকে বেশী বেগে ছুটতে পারে না।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কিছু গভীর সত্য এই C এর সাথে জড়িয়ে আছে। গত দুশো বছর ধরে পরতে পরতে তার উন্মোচনের মধ্যে ধরা আছে বিজ্ঞানের জয়যাত্রার কাহিনী। সবটা বলতে গেলে সাতকাহন, তাই সে চেষ্টা না করে একটা বা দুটো ঘটনা নিয়ে লিখব পরের পর্বে।
(২)
ইলেকট্রিক চার্জের পরিভাষা হচ্ছে বৈদ্যুতিক আধান। কিন্তু আজকাল কেউ বলে না , ‘আমার মোবাইলটাকে আধানিত করতে হবে’। তাই ক্ষেত্রবিশেষে পরিভাষার প্রয়োগ পরিহার করলে আশা করি মার্জনা করবেন।
অষ্টাদশ শতকে ফরাসী বৈজ্ঞানিক কুলম্ব দুটি চার্জের মধ্যে যে বল কাজ করে, তার সূত্র আবিষ্কার করেন। তিনি দেখালেন ওই বল চার্জ দুটির মাপ ও তাদের মধ্যের দুরত্বের ওপর নির্ভর করে।আরও সঠিকভাবে বললে, চার্জ দুটির মাপের গুণফল যত বেশী হবে, তত জোরে তারা একে অপরকে টানবে বা ঠেলে দেবে; দুরত্ব যত বেশী হবে, তার বর্গের অনুপাতে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ দুর্বল হবে।
নিউটন মহাকর্ষ বলেরও একই সূত্র দিয়েছিলেন- তফাৎ শুধু এই যে মহাকর্ষের বল চার্জের বদলে বস্তুর ভরের ওপর নির্ভরশীল। এই যে সমাপতন সেটা কি নেহাত কাকতালীয় নাকি প্রকৃতির কোনো গভীর সত্য এতে লুকিয়ে আছে? এখনও আমরা জানি না।
মহাকর্ষের বল হিসেব করতে একটা ধ্রুবক চলে আসে, যাকে আমরা বলি মহাকর্ষীয় ধ্রুবক। ঠিক তেমনি শূন্যে থাকা দুটি চার্জের মধ্যের বল বার করতে একটা ধ্রুবক চলে আসে, যেটাকে গ্রীক অক্ষর এপ্সিলন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। দুটি চৌম্বক মেরুর মধ্যে যে বল কাজ করে তার সূত্রও একই ধরণের, সেখানে যে ধ্রুবকটি নিতে হয় তার চিহ্ন গ্রীক অক্ষর মিউ।
আঠেরোর শতকে ইউরোপে মাইকেল ফ্যারাডে, কার্ল গাউস, আঁদ্রে এম্পিয়ার, হেইনরিখ লেঞ্জদের মত দিকপাল পদার্থবিদরা বিদ্যুৎ ও চুম্বকীয় বল নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা ও তত্ত্ব প্রকাশ করছিলেন। এঁদের মধ্যেই একজন, জার্মান বিজ্ঞানী গুস্তাভ কির্খফ (আমাদের দেশের স্কুলকলেজে পড়ুয়ারা এঁকে কির্সফ নামে জানেন, সেটা ঠিক হলেও হতে পারে)এপ্সিলন আর মিউএর মান নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন।তাঁরই নজরে এল ব্যাপারটা। মিউ আর এপ্সিলনের গুণফলের যদি বর্গমূল করা হয়, সেটাকে উল্টে দিলে পাওয়া যাচ্ছে আলোর গতি C , ঠিক যেমন ১/২ এর উল্টো বা রেসিপ্রোকাল হচ্ছে ২, ২ এর উল্টো ১/২। নেহাতই কাকতালীয়? না এদের মধ্যে কোনো গভীর সম্বন্ধ রয়েছে?
স্কটল্যান্ডের পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ওই শতকের ষাটের দশকে লন্ডনের কিংস কলেজে অধ্যাপক ছিলেন। ততদিনে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে বিদ্যুৎ বা তড়িৎক্ষেত্র আর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তড়িৎক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন জন্ম দেয় চৌম্বক ক্ষেত্রের আবার চৌম্বক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটলে তার চারদিকে তড়িৎ ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়। এই সম্পর্কগুলোকে ম্যাক্সওয়েল চারটি সমীকরণে প্রকাশ করলেন। তাদের একটির সাথে অন্যটিকে গেঁথে তিনি পেলেন একটি মাত্র সমীকরণ। সেটা একটা ধাবমান তরঙ্গের সমীকরণ, তার এগিয়ে চলার গতি হচ্ছে মিউ আর এপ্সিলনের গুণফলের বর্গমূলের রেসিপ্রোকাল। অর্থাৎ সেই C ।আক্ষরিক অর্থেই হাতে কলমে প্রমাণ হয়ে গেল আলো আসলে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ।
আমাদের মোবাইল ফোনের ‘সিগন্যাল’, রেডিওতরঙ্গ, মাইক্রোওয়েভ, এক্সরে, তেজস্ক্রিয় রশ্মি গামারে- এসবই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। অর্থাৎ একই প্রজাতি, শুধু বর্ণের ভেদ। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থে বর্ণই। নানা রঙের আলোর প্রভেদ তাদের কম্পাঙ্কে, ওই কম্পাঙ্কই আলাদা করে রেডিও তরঙ্গ থেকে এক্সরেকে। সূর্যের তাপ পৃথিবীতে সেই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের আকারেই এসে পৌঁছয়। রেডিওর এরিয়ালে একইসাথে এসে পড়ছে রেডিও তরঙ্গ, মোবাইলের সিগন্যাল, সূর্যের আলো।এদের একেকটা এক এক কম্পাঙ্কের। তাদের মধ্যে রেডিওর তরঙ্গই শুধু সেই এরিয়ালে ধরা পড়ে, ঠিক যেমন আমাদের চোখে ধরা পড়ে শুধু আলো। প্রকৃতি আমাদের চোখের ভেতরের এন্টেনাগুলো ওই মাপেই বানিয়েছেন কি না!
রেডিও তরঙ্গের উৎস রেডিওস্টেশনের ট্রান্সমিটার, মোবাইল সিগন্যালের উৎস টাওয়ারের নীচে থাকা যন্ত্রপাতি, তাহলে আলোর উৎস কি? এই প্রশ্নের উত্তর প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষ জানে। আগুণ জ্বাললেই আলো। কিন্তু এতে কোথায়ই বা তড়িৎ, কোথায় চুম্বক? এর উত্তর ম্যাক্সওয়েলের সময়েও জানা ছিল না। তারজন্য বিজ্ঞানকে অপেক্ষা করতে হল পরের শতাব্দী অবধি, যখন ইলেকট্রন, প্রোটন আর পরমাণুর গঠন নিয়ে নতুন নতুন তথ্য হাতে আসতে লাগলো।জানা গেল, পরমাণুতে প্রোটনের টানে বাঁধা পড়া ইলেকট্রন থেকেই বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে বেরিয়ে আসে এই বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আলোর রূপ ধরে। তা সে জোনাকির আলোই হোক আর মোবাইল বা ল্যাপটপের এলইডি স্ক্রীন হোক।
আলোর গতি C দেখা গেল স্রেফ দুটো ধ্রুবকের মানের ওপর নির্ভরশীল। আলোর উৎসের গতি বা যে দেখছে তার গতির সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এই সাধারণ সত্যটার মধ্যে যে কত অসাধারণ তাৎপর্য লুকিয়ে আছে, একশো বছর ধরে সেটা কারও চিন্তায় ধরা দেয় নি।যখন ধরা পড়ল, পদার্থবিদ্যার জগতটাই ওলটপালট হয়ে গেল। পরের পর্বে তার কথা।
(৩)
উনিশ শতকে নতুন নতুন আবিষ্কার বিজ্ঞানের জগতটাকে দ্রুত পাল্টে দিচ্ছিল। সাধারণ মানুষ, যারা বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করেন না, তাদের জন্য আরন বার্ন্সটাইন নামে এক জার্মান ইহুদী বিজ্ঞানী ১৮৮০ সালে ‘পপুলার বুক অফ ন্যাচারাল সাইন্সেস’ – এই নাম দিয়ে কয়েক খণ্ডে বই প্রকাশ করেন। তাঁর বইগুলো এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় তার অনুবাদ প্রকাশিত হয়। কিশোরমনের কল্পনাকে উস্কে দেওয়া এমন বই যে কতশত মন আর চোখ খুলে দেয়, তার কোনো খোঁজ কেউ রাখে না।
এমনই এক কিশোর আপন খেয়ালে ইতালির গ্রামের মেঠো রাস্তায় সাইকেল চেপে ঘুরে বেড়ায়। পারিবারিক ব্যাবসায় বিপর্যয়ের মুখে পড়ে তার বাবা সপরিবারে জার্মানির মিউনিখ থেকে ইতালিতে চলে এসেছেন। ছেলের পড়াশোনায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই তিনি ছেলেকে মিউনিখে রেখে এসেছিলেন। কিন্তু ওই স্কুলের পড়ানোর ধরণধারণ ছেলেটির একেবারেই পোষাচ্ছিল না। এই নিয়ে শিক্ষকদের সাথে বাদানুবাদ হওয়ায় তাকে স্কুল ছাড়তে হয়। নেহাতই সাধারণ মানের এক ছাত্রের এহেন ঔদ্ধত্ব শিক্ষকরা মেনে নেবেন না বলাই বাহুল্য। কিশোরটি চলে আসে ইতালিতে, তার বাবা মার কাছে।
স্কুলের পাঠ্য বিষয়গুলোর মধ্যে অঙ্ক আর পদার্থবিদ্যা ছেলেটির খুব মনে ধরেছিল। এরমধ্যেই বার্ন্সটাইনের বই তার পড়া হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ আর আলোর অকল্পনীয় দ্রুতগতির ব্যাপারটা তার মাথা থেকে যেন নামতেই চাইছিলনা। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে সে ভাবতো, কেমন হয়, যদি সাইকেলকে ছুটিয়ে দেওয়া যায় জোরে, আরও জোরে, আলোর গতির সীমানায়......।ঠিক যেন ঢেউএর পিঠে সওয়ার হয়ে ছুটে যাওয়া। কিন্তু আলোর বেলায় এমন পরিস্থিতিতে তো গোটা ব্যাপারটাই কেমন যেন গোলমেলে হয়ে যাবে! আলোর তড়িৎক্ষেত্র আর চৌম্বকক্ষেত্র হয়ে যাবে স্থাণু- তাহলে আলোরই তো অস্তিত্ব থাকবে না!
কিশোর এ্যালবার্ট ভেবে ভেবে তল পায় না। আলোর গতিকে ছোঁয়া দূরে থাক, তার কাছাকাছি পৌঁছলেও এমন ভূতুরে সব ব্যাপারস্যাপার ঘটে যাওয়ার কথা, বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে যা একেবারেই সামঞ্জস্যহীন।
ধরুন আপনি দুটি বাচ্চা ছেলের কাছে দাঁড়িয়ে তাদের বল ছোঁড়াছুড়ি দেখছেন। দূরে থাকা ছেলেটি বল ছুঁড়ে দিচ্ছে, আপনার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি সেটা লুফে নিচ্ছে। এবার যদি আমরা ধরে নিই যে কখনও কোনো পরিস্থিতিতে বলের গতি আলোর গতির থেকে বেশী হয়, তবে আপনি কি দেখবেন? দূরের ছেলেটির বল ছোঁড়ার দৃশ্যটি আপনার চোখে এসে পৌঁছনোর আগেই আপনি দেখবেন কাছের ছেলেটি বল লুফে নিচ্ছে। অর্থাৎ কার্যকারণ সম্পর্ক বলে কিছু থাকবে না।
বছর গড়িয়ে যেতে এ্যালবার্ট ভর্তি হল জুরিখের একটি পলিটেকনিকে।অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যায় শিক্ষকদের নজর কাড়লেও চার বছর বাদে স্নাতক হওয়ার পর শিক্ষকের চাকরী জোটাতে পারল না। দুবছর বিফল চেষ্টার পর পেটেন্ট অফিসেই ঢুকে পড়ল যুবক এ্যালবার্ট আইনস্টাইন।
প্রেম, বিয়ে, সংসার- নানা ঘটনায় দ্রুত ঘুরে যায় কয়েকটি বছর। সময় পেলেই আইনস্টাইন আলোর গতি ও গতিবিদ্যা নিয়ে মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকা প্রশ্নগুলো নিয়ে বসে পড়েন। ১৯০৫ সালে তাঁর যুগান্তকারী গবেষণাপত্র প্রকাশ পেল- যার শিরোনাম, ইংরাজি তর্জমায়, ‘On electrodynamics of moving bodies’.
গোড়াতেই আইনস্টাইন দুটি স্বীকার্য বা ‘Postulate’ মেনে নেন- ১) আলোর গতি উৎসের গতি- নিরপেক্ষ। মাটিতে দাঁড়িয়ে বন্দুক ছুঁড়লে গুলিটি যে গতি পাবে, একটি এরোপ্লেনে বসে গন্তব্যের দিকে গুলি ছুঁড়লে তার গতি হবে অনেক বেশী , কিন্তু আলোর বেলায় সেটি হবার যো নেই। টর্চ, সে প্লেনের যাত্রীর হাতেই থাক, আর মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকের হাতেই থাক, সেটা জ্বাললে তার থেকে বেরোনো আলো একই গতি নিয়ে ছুটে যাবে। ২) পদার্থবিদ্যার নিয়ম সর্বত্র এক, তা সে স্থির মাটির ওপরে হোক অথবা সুষম গতিতে যেতে থাকা কোনো গাড়িতে হোক। স্রেফ যুক্তি খাটিয়ে আর সহজবোধ্য অঙ্ক দিয়ে আইনস্টাইন দেখিয়ে দিলেন, যে কোনো সুষম গতিতে যেতে থাকা একটি গাড়িতে বসে কেউ কোনো একটি জিনিষের যে দৈর্ঘ, ভর বা ঘড়িতে যে সময় মাপবে, সেটি স্থির অবস্থায় মাপা একই জিনিষের দৈর্ঘ ও ভর বা একই ঘড়িতে মাপা সময় থেকে আলাদা। কিন্তু আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা তো তা বলছে না! আসলে ফারাকটা এতোটাই সূক্ষ্ম যে আমাদের কাছে সেটা ধরা পড়ে না। তাই আইনস্টাইন নিউটনের বলবিদ্যাকে ভুল প্রমাণ করলেও ভ্রান্তির পরিমাণ এতোটাই কম যে আমাদের রোজকার কাজে আমরা চোখ বুজেই নিউটনের মেকানিক্স প্রয়োগ করতে পারি।
যখনই কোনো জিনিষের গতি আলোর গতির কাছাকাছি হয়ে যাবে, তখন নিউটনের নিয়ম আর খাটবে না, তখন আইনস্টাইন সহায়- যেমন পরীক্ষাগারে মৌল কণাদের গতি বা পরমাণুতে ইলেকট্রনের গতি।
আইনস্টাইনের এই ‘বিশেষ আপাক্ষিকতা’ আরেকটি গভীর সত্যকে উদ্ঘাটন করে- সেটা হল যে ভর ও শক্তি একই জিনিষের এপিঠ- ওপিঠ। ভরকে আলোর গতির বর্গ দিয়ে গুণ করলে শক্তির পরিমাণ পাওয়া যায়। এই অতি সরল সত্যটির তাৎপর্য অসীম। একাধারে সুন্দর ও ভয়ংকর। সেটা আজ কারো অজানা নেই।
আলোর গতি উৎসের গতির ওপর নির্ভর না করলেও মাধ্যমের ওপর নির্ভর করে। কারণ আপাতদৃষ্টিতে খুবই সরল; ওই যে মিউ আর এপ্সিলনের কথা বলেছিলাম, তাদের মান এক এক মাধ্যমে একেক রকম। জলে বা কাঁচে আলোর গতিবেগ শূন্যে তার গতিবেগ থেকে কম- আলোর প্রতিসরণের কারণ এটাই। চৌবাচ্চা বা সুইমিং পুলের গভীরতা তাই বাইরে থেকে অনেকটাই কম বলে মনে হয়। আলোর প্রতিসরণের ফলেই বাইরের জগতের ছবি আমাদের অক্ষিপটে পড়ে। হীরের চোখ ধাঁধানো দ্যুতির কারণও এই প্রতিসরণ বা অন্যভাবে বললে, বিভিন্ন মাধ্যমে আলোর বেগের তারতম্য।
আবার আলোর গতি তার রঙের ওপরও নির্ভর করে। রামধনুর রঙের বাহার ওই জন্যই।
এই পর্যায় শেষ করার আগে দুটি মজার ব্যাপার উল্লেখ করছি। আলোর গতি নিয়ে একটি রসিকতা আইনস্টাইনের উক্তি বলে প্রচলিত আছে, সেটা এরকম-‘ We all know that light travels faster than sound. That’s why certain people appear bright until you hear them speak.”
দ্বিতীয়টি একটি ইংরেজি লিমেরিক, রচয়িতা অজ্ঞাত-
“ There was a young lady named Bright
Whose speed was far faster than light;
She set out one day
In a relative way
And returned on the previous night; “
-------------------------------------------------------------------------
আসলে বিজ্ঞানীটি মাপতে চলেছিলেন আলোর গতিবেগ।যেটা এতকাল অসীম বলেই ধরে এসেছে সবাই। কিন্তু তিনি যেহেতু গ্যালিলিও, প্রমাণ ছাড়া সেটা মেনে নেন কি করে?
কিন্তু সে যাত্রায় গ্যালিলিওকে নিরাশ হতে হল। আজ আমরা জানি, এক মাইল পথ আসা যাওয়া করতে আলো সময় নেয় সেকেন্ডের একলক্ষ ভাগের একভাগ প্রায়। ওই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মানুষের কর্ম নয়, তাই গ্যালিলিওর কাছে অসীম ধরা দিল না।তবে ওই অসীমের ব্যাপারটাতেও তিনি নিঃসন্দিহান হতে পারলেন না।
এর কয়েক দশক পরে ১৬৭৬ সালে ডেনমার্কের বিজ্ঞানী রোমার দূরবীনে বৃহস্পতির উপগ্রহ আইওর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বৃহস্পতির চারদিকে পাক খেতে খেতে আইও গ্রহের পিছনে ঢাকা পরে গেলে তার গ্রহণ হয়, রোমার দেখলেন গ্রহণ একই সময়ে হচ্ছে না। বৃহস্পতি যখন পৃথিবীর একেবারে কাছে, তখন গ্রহণের সময় এগিয়ে যাচ্ছে। রাতের আকাশে যখন বৃহস্পতি পৃথিবীর থেকে সবচাইতে দূরে, তখন গ্রহণের সময় প্রায় দশ মিনিট পিছিয়ে যাচ্ছে। এর একটাই ব্যাখা সম্ভব- যখন বৃহস্পতি ও আইও বেশী দূরে, আইও থেকে প্রতিফলিত আলো পৃথিবীতে আসতে বেশী সময় নিচ্ছে। আলোর গতি প্রচণ্ড বেশী হলেও যে তা সীমিত, তার প্রমাণ হাতেনাতে পাওয়া গেল।
কিন্তু সেই গতিবেগ কত? রোমারের সময় পৃথিবী থেকে সূর্যের দুরত্ব জানা ছিল না। তাই সেই গতির হিসেব করা গেল না। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রাডলি দেখলেন, রাতের আকাশে একটা বিশেষ সময়ে কোন একটি তারার অবস্থান একই থাকছে না। পৃথিবী তার কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে তার বেগ বাড়ে কমে - যখন সূর্যের কাছে, তখন তার বেগ বেশী, দূরে গেলে কম। পৃথিবীর বেগের সাথে সাথে তারাদের অবস্থানে সূক্ষ্ম পরিবর্তন হচ্ছে। একে বলে Stellar aberration । তিনি অঙ্ক কষে দেখলেন এই পরিবর্তনের মান পৃথিবীর গতি আর আলোর গতির আনুপাতিক হওয়া উচিত। পৃথিবীর গতি যেহেতু জানা ছিল, ব্রাডলি মানব ইতিহাসে প্রথম আলোর গতির পরিমাপ করতে পারলেন- তিন লক্ষ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড।
ব্রাডলির পর কেটে গেছে প্রায় তিনটি শতাব্দী। এখন আমরা একদিকে যেমন পেয়েছি লেজার রশ্মি তেমনি হাতে পেয়েছি নিমেষ- মুহূর্ত মাপার মত সূক্ষ ঘড়ি। এসব নিয়ে মাপজোখ করে আলোর গতির যে সর্বাধুনিক পরিমাপ পাওয়া গেছে, সেটা হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ২৯,৯৭,৯২, ৪৫৮ মিটার। অর্থাৎ ২.৯৯ লক্ষ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড। তিনশো বছর আগের ব্রাডলি সাহেবের পর্যবেক্ষণের তারিফ না করে উপায় নেই!
আলোর গতি আমাদের সবার কাছে C চিহ্নে পরিচিত। এই C এসেছে লাতিন Celeritas থেকে। যার অর্থ ক্ষিপ্রতা। আজ আমরা জানি, ক্ষিপ্রতার পরাকাষ্ঠা আলোর গতি। কোনো পদার্থ বা শক্তি এর থেকে বেশী বেগে ছুটতে পারে না।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কিছু গভীর সত্য এই C এর সাথে জড়িয়ে আছে। গত দুশো বছর ধরে পরতে পরতে তার উন্মোচনের মধ্যে ধরা আছে বিজ্ঞানের জয়যাত্রার কাহিনী। সবটা বলতে গেলে সাতকাহন, তাই সে চেষ্টা না করে একটা বা দুটো ঘটনা নিয়ে লিখব পরের পর্বে।
(২)
ইলেকট্রিক চার্জের পরিভাষা হচ্ছে বৈদ্যুতিক আধান। কিন্তু আজকাল কেউ বলে না , ‘আমার মোবাইলটাকে আধানিত করতে হবে’। তাই ক্ষেত্রবিশেষে পরিভাষার প্রয়োগ পরিহার করলে আশা করি মার্জনা করবেন।
অষ্টাদশ শতকে ফরাসী বৈজ্ঞানিক কুলম্ব দুটি চার্জের মধ্যে যে বল কাজ করে, তার সূত্র আবিষ্কার করেন। তিনি দেখালেন ওই বল চার্জ দুটির মাপ ও তাদের মধ্যের দুরত্বের ওপর নির্ভর করে।আরও সঠিকভাবে বললে, চার্জ দুটির মাপের গুণফল যত বেশী হবে, তত জোরে তারা একে অপরকে টানবে বা ঠেলে দেবে; দুরত্ব যত বেশী হবে, তার বর্গের অনুপাতে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ দুর্বল হবে।
নিউটন মহাকর্ষ বলেরও একই সূত্র দিয়েছিলেন- তফাৎ শুধু এই যে মহাকর্ষের বল চার্জের বদলে বস্তুর ভরের ওপর নির্ভরশীল। এই যে সমাপতন সেটা কি নেহাত কাকতালীয় নাকি প্রকৃতির কোনো গভীর সত্য এতে লুকিয়ে আছে? এখনও আমরা জানি না।
মহাকর্ষের বল হিসেব করতে একটা ধ্রুবক চলে আসে, যাকে আমরা বলি মহাকর্ষীয় ধ্রুবক। ঠিক তেমনি শূন্যে থাকা দুটি চার্জের মধ্যের বল বার করতে একটা ধ্রুবক চলে আসে, যেটাকে গ্রীক অক্ষর এপ্সিলন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। দুটি চৌম্বক মেরুর মধ্যে যে বল কাজ করে তার সূত্রও একই ধরণের, সেখানে যে ধ্রুবকটি নিতে হয় তার চিহ্ন গ্রীক অক্ষর মিউ।
আঠেরোর শতকে ইউরোপে মাইকেল ফ্যারাডে, কার্ল গাউস, আঁদ্রে এম্পিয়ার, হেইনরিখ লেঞ্জদের মত দিকপাল পদার্থবিদরা বিদ্যুৎ ও চুম্বকীয় বল নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা ও তত্ত্ব প্রকাশ করছিলেন। এঁদের মধ্যেই একজন, জার্মান বিজ্ঞানী গুস্তাভ কির্খফ (আমাদের দেশের স্কুলকলেজে পড়ুয়ারা এঁকে কির্সফ নামে জানেন, সেটা ঠিক হলেও হতে পারে)এপ্সিলন আর মিউএর মান নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন।তাঁরই নজরে এল ব্যাপারটা। মিউ আর এপ্সিলনের গুণফলের যদি বর্গমূল করা হয়, সেটাকে উল্টে দিলে পাওয়া যাচ্ছে আলোর গতি C , ঠিক যেমন ১/২ এর উল্টো বা রেসিপ্রোকাল হচ্ছে ২, ২ এর উল্টো ১/২। নেহাতই কাকতালীয়? না এদের মধ্যে কোনো গভীর সম্বন্ধ রয়েছে?
স্কটল্যান্ডের পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ওই শতকের ষাটের দশকে লন্ডনের কিংস কলেজে অধ্যাপক ছিলেন। ততদিনে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে বিদ্যুৎ বা তড়িৎক্ষেত্র আর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তড়িৎক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন জন্ম দেয় চৌম্বক ক্ষেত্রের আবার চৌম্বক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটলে তার চারদিকে তড়িৎ ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়। এই সম্পর্কগুলোকে ম্যাক্সওয়েল চারটি সমীকরণে প্রকাশ করলেন। তাদের একটির সাথে অন্যটিকে গেঁথে তিনি পেলেন একটি মাত্র সমীকরণ। সেটা একটা ধাবমান তরঙ্গের সমীকরণ, তার এগিয়ে চলার গতি হচ্ছে মিউ আর এপ্সিলনের গুণফলের বর্গমূলের রেসিপ্রোকাল। অর্থাৎ সেই C ।আক্ষরিক অর্থেই হাতে কলমে প্রমাণ হয়ে গেল আলো আসলে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ।
আমাদের মোবাইল ফোনের ‘সিগন্যাল’, রেডিওতরঙ্গ, মাইক্রোওয়েভ, এক্সরে, তেজস্ক্রিয় রশ্মি গামারে- এসবই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। অর্থাৎ একই প্রজাতি, শুধু বর্ণের ভেদ। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থে বর্ণই। নানা রঙের আলোর প্রভেদ তাদের কম্পাঙ্কে, ওই কম্পাঙ্কই আলাদা করে রেডিও তরঙ্গ থেকে এক্সরেকে। সূর্যের তাপ পৃথিবীতে সেই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের আকারেই এসে পৌঁছয়। রেডিওর এরিয়ালে একইসাথে এসে পড়ছে রেডিও তরঙ্গ, মোবাইলের সিগন্যাল, সূর্যের আলো।এদের একেকটা এক এক কম্পাঙ্কের। তাদের মধ্যে রেডিওর তরঙ্গই শুধু সেই এরিয়ালে ধরা পড়ে, ঠিক যেমন আমাদের চোখে ধরা পড়ে শুধু আলো। প্রকৃতি আমাদের চোখের ভেতরের এন্টেনাগুলো ওই মাপেই বানিয়েছেন কি না!
রেডিও তরঙ্গের উৎস রেডিওস্টেশনের ট্রান্সমিটার, মোবাইল সিগন্যালের উৎস টাওয়ারের নীচে থাকা যন্ত্রপাতি, তাহলে আলোর উৎস কি? এই প্রশ্নের উত্তর প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষ জানে। আগুণ জ্বাললেই আলো। কিন্তু এতে কোথায়ই বা তড়িৎ, কোথায় চুম্বক? এর উত্তর ম্যাক্সওয়েলের সময়েও জানা ছিল না। তারজন্য বিজ্ঞানকে অপেক্ষা করতে হল পরের শতাব্দী অবধি, যখন ইলেকট্রন, প্রোটন আর পরমাণুর গঠন নিয়ে নতুন নতুন তথ্য হাতে আসতে লাগলো।জানা গেল, পরমাণুতে প্রোটনের টানে বাঁধা পড়া ইলেকট্রন থেকেই বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে বেরিয়ে আসে এই বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ আলোর রূপ ধরে। তা সে জোনাকির আলোই হোক আর মোবাইল বা ল্যাপটপের এলইডি স্ক্রীন হোক।
আলোর গতি C দেখা গেল স্রেফ দুটো ধ্রুবকের মানের ওপর নির্ভরশীল। আলোর উৎসের গতি বা যে দেখছে তার গতির সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এই সাধারণ সত্যটার মধ্যে যে কত অসাধারণ তাৎপর্য লুকিয়ে আছে, একশো বছর ধরে সেটা কারও চিন্তায় ধরা দেয় নি।যখন ধরা পড়ল, পদার্থবিদ্যার জগতটাই ওলটপালট হয়ে গেল। পরের পর্বে তার কথা।
(৩)
উনিশ শতকে নতুন নতুন আবিষ্কার বিজ্ঞানের জগতটাকে দ্রুত পাল্টে দিচ্ছিল। সাধারণ মানুষ, যারা বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করেন না, তাদের জন্য আরন বার্ন্সটাইন নামে এক জার্মান ইহুদী বিজ্ঞানী ১৮৮০ সালে ‘পপুলার বুক অফ ন্যাচারাল সাইন্সেস’ – এই নাম দিয়ে কয়েক খণ্ডে বই প্রকাশ করেন। তাঁর বইগুলো এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় তার অনুবাদ প্রকাশিত হয়। কিশোরমনের কল্পনাকে উস্কে দেওয়া এমন বই যে কতশত মন আর চোখ খুলে দেয়, তার কোনো খোঁজ কেউ রাখে না।
এমনই এক কিশোর আপন খেয়ালে ইতালির গ্রামের মেঠো রাস্তায় সাইকেল চেপে ঘুরে বেড়ায়। পারিবারিক ব্যাবসায় বিপর্যয়ের মুখে পড়ে তার বাবা সপরিবারে জার্মানির মিউনিখ থেকে ইতালিতে চলে এসেছেন। ছেলের পড়াশোনায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই তিনি ছেলেকে মিউনিখে রেখে এসেছিলেন। কিন্তু ওই স্কুলের পড়ানোর ধরণধারণ ছেলেটির একেবারেই পোষাচ্ছিল না। এই নিয়ে শিক্ষকদের সাথে বাদানুবাদ হওয়ায় তাকে স্কুল ছাড়তে হয়। নেহাতই সাধারণ মানের এক ছাত্রের এহেন ঔদ্ধত্ব শিক্ষকরা মেনে নেবেন না বলাই বাহুল্য। কিশোরটি চলে আসে ইতালিতে, তার বাবা মার কাছে।
স্কুলের পাঠ্য বিষয়গুলোর মধ্যে অঙ্ক আর পদার্থবিদ্যা ছেলেটির খুব মনে ধরেছিল। এরমধ্যেই বার্ন্সটাইনের বই তার পড়া হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ আর আলোর অকল্পনীয় দ্রুতগতির ব্যাপারটা তার মাথা থেকে যেন নামতেই চাইছিলনা। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে সে ভাবতো, কেমন হয়, যদি সাইকেলকে ছুটিয়ে দেওয়া যায় জোরে, আরও জোরে, আলোর গতির সীমানায়......।ঠিক যেন ঢেউএর পিঠে সওয়ার হয়ে ছুটে যাওয়া। কিন্তু আলোর বেলায় এমন পরিস্থিতিতে তো গোটা ব্যাপারটাই কেমন যেন গোলমেলে হয়ে যাবে! আলোর তড়িৎক্ষেত্র আর চৌম্বকক্ষেত্র হয়ে যাবে স্থাণু- তাহলে আলোরই তো অস্তিত্ব থাকবে না!
কিশোর এ্যালবার্ট ভেবে ভেবে তল পায় না। আলোর গতিকে ছোঁয়া দূরে থাক, তার কাছাকাছি পৌঁছলেও এমন ভূতুরে সব ব্যাপারস্যাপার ঘটে যাওয়ার কথা, বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে যা একেবারেই সামঞ্জস্যহীন।
ধরুন আপনি দুটি বাচ্চা ছেলের কাছে দাঁড়িয়ে তাদের বল ছোঁড়াছুড়ি দেখছেন। দূরে থাকা ছেলেটি বল ছুঁড়ে দিচ্ছে, আপনার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি সেটা লুফে নিচ্ছে। এবার যদি আমরা ধরে নিই যে কখনও কোনো পরিস্থিতিতে বলের গতি আলোর গতির থেকে বেশী হয়, তবে আপনি কি দেখবেন? দূরের ছেলেটির বল ছোঁড়ার দৃশ্যটি আপনার চোখে এসে পৌঁছনোর আগেই আপনি দেখবেন কাছের ছেলেটি বল লুফে নিচ্ছে। অর্থাৎ কার্যকারণ সম্পর্ক বলে কিছু থাকবে না।
বছর গড়িয়ে যেতে এ্যালবার্ট ভর্তি হল জুরিখের একটি পলিটেকনিকে।অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যায় শিক্ষকদের নজর কাড়লেও চার বছর বাদে স্নাতক হওয়ার পর শিক্ষকের চাকরী জোটাতে পারল না। দুবছর বিফল চেষ্টার পর পেটেন্ট অফিসেই ঢুকে পড়ল যুবক এ্যালবার্ট আইনস্টাইন।
প্রেম, বিয়ে, সংসার- নানা ঘটনায় দ্রুত ঘুরে যায় কয়েকটি বছর। সময় পেলেই আইনস্টাইন আলোর গতি ও গতিবিদ্যা নিয়ে মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকা প্রশ্নগুলো নিয়ে বসে পড়েন। ১৯০৫ সালে তাঁর যুগান্তকারী গবেষণাপত্র প্রকাশ পেল- যার শিরোনাম, ইংরাজি তর্জমায়, ‘On electrodynamics of moving bodies’.
গোড়াতেই আইনস্টাইন দুটি স্বীকার্য বা ‘Postulate’ মেনে নেন- ১) আলোর গতি উৎসের গতি- নিরপেক্ষ। মাটিতে দাঁড়িয়ে বন্দুক ছুঁড়লে গুলিটি যে গতি পাবে, একটি এরোপ্লেনে বসে গন্তব্যের দিকে গুলি ছুঁড়লে তার গতি হবে অনেক বেশী , কিন্তু আলোর বেলায় সেটি হবার যো নেই। টর্চ, সে প্লেনের যাত্রীর হাতেই থাক, আর মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকের হাতেই থাক, সেটা জ্বাললে তার থেকে বেরোনো আলো একই গতি নিয়ে ছুটে যাবে। ২) পদার্থবিদ্যার নিয়ম সর্বত্র এক, তা সে স্থির মাটির ওপরে হোক অথবা সুষম গতিতে যেতে থাকা কোনো গাড়িতে হোক। স্রেফ যুক্তি খাটিয়ে আর সহজবোধ্য অঙ্ক দিয়ে আইনস্টাইন দেখিয়ে দিলেন, যে কোনো সুষম গতিতে যেতে থাকা একটি গাড়িতে বসে কেউ কোনো একটি জিনিষের যে দৈর্ঘ, ভর বা ঘড়িতে যে সময় মাপবে, সেটি স্থির অবস্থায় মাপা একই জিনিষের দৈর্ঘ ও ভর বা একই ঘড়িতে মাপা সময় থেকে আলাদা। কিন্তু আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতা তো তা বলছে না! আসলে ফারাকটা এতোটাই সূক্ষ্ম যে আমাদের কাছে সেটা ধরা পড়ে না। তাই আইনস্টাইন নিউটনের বলবিদ্যাকে ভুল প্রমাণ করলেও ভ্রান্তির পরিমাণ এতোটাই কম যে আমাদের রোজকার কাজে আমরা চোখ বুজেই নিউটনের মেকানিক্স প্রয়োগ করতে পারি।
যখনই কোনো জিনিষের গতি আলোর গতির কাছাকাছি হয়ে যাবে, তখন নিউটনের নিয়ম আর খাটবে না, তখন আইনস্টাইন সহায়- যেমন পরীক্ষাগারে মৌল কণাদের গতি বা পরমাণুতে ইলেকট্রনের গতি।
আইনস্টাইনের এই ‘বিশেষ আপাক্ষিকতা’ আরেকটি গভীর সত্যকে উদ্ঘাটন করে- সেটা হল যে ভর ও শক্তি একই জিনিষের এপিঠ- ওপিঠ। ভরকে আলোর গতির বর্গ দিয়ে গুণ করলে শক্তির পরিমাণ পাওয়া যায়। এই অতি সরল সত্যটির তাৎপর্য অসীম। একাধারে সুন্দর ও ভয়ংকর। সেটা আজ কারো অজানা নেই।
আলোর গতি উৎসের গতির ওপর নির্ভর না করলেও মাধ্যমের ওপর নির্ভর করে। কারণ আপাতদৃষ্টিতে খুবই সরল; ওই যে মিউ আর এপ্সিলনের কথা বলেছিলাম, তাদের মান এক এক মাধ্যমে একেক রকম। জলে বা কাঁচে আলোর গতিবেগ শূন্যে তার গতিবেগ থেকে কম- আলোর প্রতিসরণের কারণ এটাই। চৌবাচ্চা বা সুইমিং পুলের গভীরতা তাই বাইরে থেকে অনেকটাই কম বলে মনে হয়। আলোর প্রতিসরণের ফলেই বাইরের জগতের ছবি আমাদের অক্ষিপটে পড়ে। হীরের চোখ ধাঁধানো দ্যুতির কারণও এই প্রতিসরণ বা অন্যভাবে বললে, বিভিন্ন মাধ্যমে আলোর বেগের তারতম্য।
আবার আলোর গতি তার রঙের ওপরও নির্ভর করে। রামধনুর রঙের বাহার ওই জন্যই।
এই পর্যায় শেষ করার আগে দুটি মজার ব্যাপার উল্লেখ করছি। আলোর গতি নিয়ে একটি রসিকতা আইনস্টাইনের উক্তি বলে প্রচলিত আছে, সেটা এরকম-‘ We all know that light travels faster than sound. That’s why certain people appear bright until you hear them speak.”
দ্বিতীয়টি একটি ইংরেজি লিমেরিক, রচয়িতা অজ্ঞাত-
“ There was a young lady named Bright
Whose speed was far faster than light;
She set out one day
In a relative way
And returned on the previous night; “
-------------------------------------------------------------------------
No comments:
Post a Comment