II দেবাশিস ভট্টাচার্য II
রাতের আকাশে ফুটে থাকা গ্রহ তারার দিকে তাকিয়ে কখনও কি আমাদের মনে হয় যে ব্রহ্মাণ্ডের অপর প্রান্তে ঠিক সেইসময় কোন জীব ঠিক ওইভাবেই অবাক বিস্ময়ে তার আকাশকে দেখছে? হয়তো তার আকাশ আমাদের আকাশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে হয়তো কোন ছায়াপথ নেই, আছে আকাশ জুড়ে রঙ বেরঙের বিচিত্র নকশা। হয়তো তার আকাশে একাধিক চাঁদ, তার মধ্যে কোনটা হয়তো আকারে আমাদের চাঁদের থেকে অনেক বড়। সেই জীবটির মনে মহাবিশ্বের ছায়া যে ভাব জাগায় তা আমাদের মনের অবাক বিস্ময়ের থেকে কতটুকু আলাদা? চাঁদের শরীর থেকে ঠিকরে আসা আলোয় যখন তার চারপাশ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, তার মনে কি প্রতিক্রিয়া হয়? সেটাকে কি আমাদের আনন্দের সমগোত্রীয় কিছু বলা চলে?
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে আমাদের চোখ দিয়েই অবলোকন করেন। তিনি আসলে উপনিষদের কথাটাকেই অন্য ব্যঞ্জনা দিয়েছেন- ‘তৎ ত্বম অসি’। কিন্তু অতিকায় এই ব্রহ্মাণ্ডের এক কোণে ক্ষুদ্র বালুকণার মত কোন একটি গ্রহের একটি বিশেষ জীবকেই তিনি কেন বেছে নেবেন? তাঁর অহৈতুকী এই কৃপা যেন অবিশ্বাস্য মনে হয়।
জীবনের বিকাশের জন্য যা যা প্রয়োজন, তেমন সব আয়োজন ব্রহ্মাণ্ডে বহু গ্রহেই আছে – এই নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত। তাদের মধ্যে উন্নত কোন জীবের বাসভূমি হয়ে ওঠার সম্ভাবনাময় গ্রহের সংখ্যাও কম নয়। স্রষ্টা তাই সম্ভবতঃ সহস্র চক্ষু দিয়ে তাঁর সৃষ্টিকে দেখছেন- ‘সহস্রশীর্ষাপুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাদ’। মানুষের ক্ষেত্রে দুই চোখের দৃশ্যপট তার মস্তিষ্কে গিয়ে মিলেমিশে বোধে ধরা দেয়। সৃষ্টির দুই প্রান্তে থাকা দুটি জীবের অনুভূতি কখনও একে অপরের ছোঁয়া পাবে না। তবে কি তারা সর্বব্যাপী কোনো চেতনার বা ধীশক্তির অঙ্গ? যাকে গায়ত্রীমন্ত্রে স্মরণ করা হয়-‘ ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ঃ যো নঃ প্রচোদয়াৎ’? কী অভিনব কল্পনা! তাঁরই প্রেরণ করা ধীশক্তি দিয়ে তাঁর জ্যোতির্ময় রূপকে কল্পনা করি- ভূঃ ভূবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং - যিনি এই ভূলোক, দ্যুলোক, সবিতারূপে বিভাসিত।
মহাবিশ্বে প্রতিমুহূর্তে যেমন সৃষ্টির যজ্ঞ চলছে, তেমনি চলছে ধ্বংসলীলা। তীক্ষ্ণ আর্তনাদের মত তীব্র বিকিরণ ছড়িয়ে দিয়ে দেশকালের গহ্বরে মিলিয়ে যাচ্ছে নক্ষত্র, গ্রহ, বস্তুপিণ্ড, আবার কোথাও প্রভাতসূর্য পরম মমতায় তার কিরণ মাখিয়ে দিচ্ছে তুচ্ছ তৃণের গায়ে। আমাদের জাগতিক জ্ঞান সৃষ্টিকে মমতা আর ধ্বংসকে ক্রুরতার সাথে এক করে দেখে। ঈশ্বরকে তাই আমরা কখনও পরম করুণাময় আবার কখনও রুদ্রবেশে কল্পনা করি। হয়তো তা আমাদের চিন্তার, আমাদের কল্পনার দীনতা।এই বিশ্বের যদি কোন সত্তা থেকে থাকে তা হয়তো সত্যিই নির্গুণ। যে মাত্রায় বা ডায়মেন্সনে আমরা বাঁধা পড়ে আছি, তাতে কার্যকারণ আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলে। তার বাইরের সামগ্রিক ছবি হয়তো আমাদের বোধে কখনো ধরা দেবে না।
বহু প্রশ্ন- দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান নিজের নিজের পথে তাদের উত্তর খুঁজে চলেছে। পথ দুরূহ- সৃষ্টির একটি ক্ষুদ্র অংশ হয়ে যেখানে আমরা পূর্ণ সৃষ্টিকে বোঝার প্রয়াস করছি, কাজটা সহজ হওয়ার কথা নয়।আদৌ সেটা সম্ভব কিনা তাও জানা নেই। আদিকাল থেকে মানুষের সংগ্রাম চলেছে প্রতিকূলতাকে জয় করে সুখ পেতে, সেই সুখ, যা আমাদের দেহকে আরাম দেয়। তবু জিজ্ঞাসুরা একসময় বুঝতে পেরেছিলেন এই সুখ আপেক্ষিক, তা সত্য হতে পারে না। ‘যো বৈ ভূমা তৎ সুখম্ নাল্পে সুখমস্তি’। বিরাটের সংস্পর্শে এসে যে সুখ দেহকে ছাপিয়ে যায়, তাই অক্ষয়, তাই অমৃত, তাই আনন্দ। ব্রহ্মাণ্ডের যে কোণই সে দাঁড়িয়ে থাক, যদি তার চিন্তাধারা উন্নত মানের হয়, সে সৃষ্টির বিশালতাকে জরীপ করার প্রয়াস করবেই।আর এই প্রয়াসই তাকে সন্ধান দেবে আনন্দের। কে জানে, এর মধ্যেই নিহিত হয়ে আছে কিনা স্রষ্টার গূঢ় অভিপ্রায়?
No comments:
Post a Comment